‘টার্গেট কিলিংয়ের’ শিকার সাঈদীর সাক্ষী হাফেজ নান্নু

প্রকাশিত: ০৫ মে ২০২৫ ০৯:০৫ এএম

রাজধানীর শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে নারকীয় গণহত্যা চালায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। সেই রাতে আলেম-উলামা, মাদরাসাছাত্রসহ নিরস্ত্র যেসব মানুষকে হত্যা করা হয়, তাদের একজন ছিলেন যশোরের হাফেজ মোয়াজ্জেমুল হক ওরফে নান্নু হুজুর। মৃত্যুর আগে তিনি স্বজনদের বলে গিয়েছিলেন, কথিত যুদ্ধাপরাধ মামলায় আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী হওয়ায় তাকে টার্গেট করে হত্যা করে পুলিশ।

নান্নুর সন্তানরা সেই তথ্যসহ গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে চিকিৎসায় বাধা দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া এবং সবশেষে তড়িঘড়ি দাফনে বাধ্য করার পৈশাচিক ঘটনার বর্ণনা দেন। তবে সে ঘটনার সঙ্গে যুক্ত পুলিশ সদস্যদের সন্ধান না পাওয়ায় তাদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

নান্নু হুজুরের মৃত্যুর আগে তার কাছ থেকে শোনা ঘটনার বর্ণনা দেন তার দুই মেয়ে উম্মে সুমাইয়া ও উম্মে সাদিয়া। সুমাইয়া বলেন, ‘আমার বাবা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দেন। মধ্যরাতে ব্ল্যাকআউট করে সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালানোর সময় বাবা বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দৌড়ে কাকরাইল মসজিদের কাছে চলে যান। সেখানে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাকে ঘিরে ধরে পিটিয়ে দুই পা ভেঙে দেয়। এরপর শরীরের বাম পাশে পেট ও বুকের মাঝখানে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে ফেলে রাখে। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে সেখানে লোকজন জড়ো হয়। এর মধ্যে এক তরুণ বাবাকে ঘাড়ে উঠিয়ে একটি রিকশায় ওঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশ তখন রিকশাটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাবার মোবাইল ফোনও পুলিশ সদস্যরা নিয়ে যায়। পরে ওই তরুণ অনেক বাধা পেরিয়ে বাবাকে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে বাবা ওই তরুণের ফোন ব্যবহার করে স্বজনদের খবর দেন।’

আরেক মেয়ে সাদিয়ার বর্ণনা, তার বাবাকে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেওয়া হলেও সেখানে চিকিৎসা দেওয়া যায়নি। পুলিশ হাসপাতালটিতে হানা দিয়ে শাপলায় আহত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে থাকে। নান্নু হুজুরকে মৃত ভেবে মর্গে পাঠানো হয়। কিছু সময় পর আশিকুর রহমান ওরফে আল আমিন নামে এক স্বজন মর্গে গিয়ে দেখেন তার হাত নড়ছে। অর্থাৎ, তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন। আল আমিন দ্রুত মর্গ থেকে নান্নুকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বারডেম, ইবনে সিনা, লালমাটিয়ার আল-মানার হাসপাতালে যান। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে যাওয়ায় কোথাও তাকে বাঁচানোর আশ্বাস পাওয়া যায়নি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা পর তার চিকিৎসা শুরু হয়। মিলেনিয়াম হার্ট অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে ৬ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সেখানেও গোয়েন্দাদের আনাগোনা বুঝতে পেরে ১০ মে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরামর্শ দিয়ে বলে যে, ‘আহত ব্যক্তির বাঁচার কোনো আশা নেই, বরং এখানে থাকলে পুলিশ লাশও নিয়ে যেতে পারে। আপনারা বরং তাকে বাড়িতে নিয়ে যান।’ তাদের পরামর্শমতো ওইদিন বিকালে নান্নুকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে যশোরের বাড়ির দিকে আনা হয়। পথে সাভারে ধসেপড়া রানা প্লাজার সামনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিনি আরো বলেন, গভীর রাতে লাশ যশোর শহরের খড়কি এলাকার বাড়িতে পৌঁছানোর পর শুরু হয় পুলিশের আরেক দফা অত্যাচার। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘তোমরা বলবে তোমাদের বাবা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তাহলে তোমাদের এক লাখ টাকা দেওয়া হবে।’ তবে আমরা পুলিশের ওই প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমার বড় বোন বলেন, ‘আমার বাবা ইসলাম রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। দুর্ঘটনার কথা বলতে পারব না।’

নিহতের স্বজনরা জানান, ভোরে হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী এবং এলাকাবাসী নান্নুর খড়কি এলাকার বাড়িতে জড়ো হন। তখনও পুলিশ বিনা গোসলে নান্নুর লাশ মাটিচাপা দেওয়ার জন্য চাপাচাপি করছিল। কিন্তু উপস্থিত জনতার তোপের মুখে পুলিশ পিছু হটে। তবে যশোর কেন্দ্রীয় ঈদগাহে সকাল ১০টায় জানাজার ঘোষণা বাতিল করতে বাধ্য হন তারা। সকাল ৭টায় সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ মাঠে জানাজা শেষে নান্নুকে দাফন করা হয় বাড়ির পাশে খড়কি কবরস্থানে।

প্রতিবেশী মেহেদী হাসান মিন্টু সেই রাতেই জানাজা ও কবর দেওয়ার জন্য প্রশাসনের চাপাচাপির কথা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আত্মীয় ও প্রতিবেশীকে না জানিয়ে দ্রুত কবর দেওয়ার তীব্র চাপ থাকলেও পরদিন খুব সকালে এমএম কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজায় বিপুল মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। এই নিপীড়নের সময় যশোর জেলা পুলিশের এসপি ছিলেন জয়দেব ভদ্র। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এখন তিনি কোথায় আছেন, তা জানা না যাওয়ায় অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

টার্গেট কিলিংয়ের অভিযোগ

জামায়াতে ইসলামী যশোর জেলা শাখার আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল বলেন, ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী থাকতেন যশোর নতুন উপশহরের ‘এ’ ব্লকের একটি বাসায়। তিনি সে সময় বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ-মাহফিলে বক্তব্য দিতেন। উপশহরের ওই বাড়িতে থাকার সময়ই প্রতিবেশী নান্নুসহ তার পরিবারের সঙ্গে আল্লামা সাঈদীর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে আল্লামা সাঈদী যশোরের বাঘারপাড়ায় থাকলেও পিরোজপুরে গণহত্যার দায়ে তাকে অভিযুক্ত করে ফ্যাসিবাদী সরকার গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই মামলায় হাফেজ নান্নু ছিলেন আল্লামা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী।

নান্নুর মেয়ে সাদিয়া এ তথ্য সমর্থন করে বলেন, ‘সাঈদী হুজুরের ছেলে বুলবুল সাঈদী ছিলেন বাবার বন্ধু। সাঈদী হুজুরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় শুধু আমার বাবা ননÑ দাদা, দাদি, বড় ফুফুও সাক্ষী ছিলেন। এ কারণেই আব্বুকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর আগে আব্বুর যতক্ষণ জ্ঞান ছিল, তিনি আমাদের সব বলে গেছেন।’ জানিয়েছেন, গুলি করার আগে পুলিশ সদস্যরা তাকে বলেছিল, ‘তুই তো সাঈদীর মামলার সাক্ষী। তোকে অনেকক্ষণ ধরে অনুসরণ করছি। আর বাঁচতে পারবি না।’

২০১৩ সালের ৫ মে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বিভিন্ন শাখার হাজার হাজার সদস্য শাপলা অভিযানে অংশ নেয়। ঠিক কোন সদস্য হাফেজ নান্নুকে গুলি করে হত্যা করে, তা আর এখন উদ্ধার করার উপায় নেই।

হাফেজ নান্নুর পরিচয়

যশোর নতুন উপশহর ‘এ’ ব্লকের মরহুম শহীদুল ইসলাম ও হামিদা খানমের সন্তান মোয়াজ্জেমুল হক নান্নু, যিনি হাফেজ নান্নু বা নান্নু হুজুর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্ত্রী শাহনাজ বেগম ও ৫ সন্তানকে নিয়ে থাকতেন শহরের খড়কী এলাকার নিজস্ব বাড়িতে। ওই বাড়ির অংশীদার তার আরেক ভাইয়ের ছেলে শহরের টালিখোলা মাদরাসার শিক্ষক মারুফ সিদ্দিকী।

নিজ বাড়ির একটি ঘর ও পাশে একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে দর্জির কাজ করতেন নান্নু। আর্থিকভাবে খুব একটা সচ্ছল না হলেও ভদ্রলোক হিসেবে এলাকায় তার বেশ সুনাম ছিল। এলাকার জামিয়া নূরিয়া মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ মো. আয়াতুল্লাহ বলেন, হাফেজ নান্নু ছিলেন পরিশ্রমী, ভদ্র, ধার্মিক।

দুর্দশায় নান্নুর পরিবার

কয়েক বছরে তিন দফা স্ট্রোকের পর শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন হাফেজ নান্নুর স্ত্রী শাহনাজ বেগম। কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিসসহ আরো নানা রোগে আক্রান্ত শাহনাজের কোমরের হাড়ও ভেঙেছে পড়ে গিয়ে। তার বড় মেয়ে উম্মে হাবিবা ক্যানসারের রোগী। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। সন্তানসহ মায়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন এই অসহায় নারী। ছোট মেয়ে উম্মে সাদিয়ারও সম্প্রতি ডিভোর্স হয়ে গেছে। তিনিও এক সন্তানসহ মায়ের কাছে এসে উঠেছেন। ঢাকায় স্বামীর সংসারে মেজো মেয়ে উম্মে সুমাইয়া ও বড় ছেলে আবু হুজাইফা রাজধানীর একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। অভাবের কারণে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি হুজাইফা। বাবার মৃত্যুর পর ছোট ছেলে কিশোর আবু হানজালারও স্ট্রোক হয়েছে। বলতে গেলে পরিবারটির যশোরে থাকা প্রায় সবাই অসুস্থ। সংসারের খরচ জোগাতে না পারায় ঠিকমতো চিকিৎসাও হচ্ছে না।

যে বাড়িতে পরিবারটি বসবাস করে, সেটি পুরো নিজের আয়ত্তে নিতে চান হাফেজ নান্নুর ভাইয়ের ছেলে মাদরাসাশিক্ষক মারুফ সিদ্দিকী। দুই পরিবারের সমঝোতার ভিত্তিতে তিনি শহরতলির আরবপুর ইউনিয়নে এক খণ্ড জমিও কেনেন। কিন্তু সেই জমির অর্ধাংশ নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেন মারুফ। আরবপুর ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী সন্ত্রাসী শাহারুল ইসলামের কারণে সেই জমির দখলও নিতে পারেনি পরিবারটি। এরই মধ্যে মারুফ সিদ্দিকী তার বিধবা চাচিসহ পরিবার-সদস্যদের বাড়ি ছাড়তে নোটিস দেন। যদিও মারুফ তার চাচা নান্নুর পরিবারের দুর্দশার কথা স্বীকার করেন। গত ১ মে সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ছাড়ার আল্টিমেটামের দিন উপায়ন্ত না পেয়ে নান্নুর মেয়ে উম্মে সাদিয়া স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তায় থানায় যান এবং ওসির পরামর্শমতো সাধারণ ডায়েরি করেন।

উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় শহীদ নান্নুর পরিবারটি মূলত শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্য-সহানুভূতির ওপর টিকে আছে। জামায়াতে ইসলামীর জেলা আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল জানান, হাফেজ নান্নু তাদের দলের সমর্থক ছিলেন। সেই দায়বোধের জায়গা থেকে তারা প্রতি মাসে পরিবারটিকে নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ সহায়তা দেন। এছাড়া উৎসবের সময় নগদ টাকাসহ বাড়তি কিছু সহযোগিতাও করা হয় দল থেকে।

হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকেও এককালীন অর্থ সহায়তা পেয়েছে পরিবারটি। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মাওলানা মামুনুল হক পরিবারটির খোঁজ-খবর নেন।

হেফাজতের অন্যতম সংগঠক মাওলানা নাসিরুল্লাহ বলেন, ‘আমরা পরিবারটিকে বিভিন্ন সময় নানাভাবে সহযোগিতা করেছি, ভবিষ্যতেও করব। তবে পারিবারিক কিছু বিষয় আছে, যেগুলো মিটিয়ে ফেললে ভালো হয়।’

যশোর জেলা পরিষদের প্রশাসক আজাহারুল ইসলামও সম্প্রতি একটি সেলাই মেশিন, কিছু কাপড় ও নগদ টাকা সহায়তা হিসেবে দিয়েছেন।

এসব তথ্য স্বীকার করে পরিবারটির সদস্যরা বলছেন, এভাবে কতদিন চলা যায়। ছোট মেয়েটি শিক্ষিত। তার একটা চাকরি হলে পরিবারটি রক্ষা পেত।

শাহনাজ বেগম তাদের এই দুর্দশার জন্য শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক শাসনকে দায়ী করেন। পরিবারটি শেখ হাসিনাসহ তার দল আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বাহিনীর খুনি সদস্যদের বিচার দাবি করেছে। নান্নুর জীবিত একমাত্র ভাই শহরতলির হাশিমপুরের বাসিন্দা হাফিজুর রহমানও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চান।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর