দশ বছর ধরে ফাইলবন্দি ‘উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা’

যত্রতত্র রোগী, নেই মানসম্মত ওয়ার্ড, কেবিন। এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষার উন্নত যন্ত্রপাতি বসানো নিয়েও জটিলতায় পড়তে হয়। নেই উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা। চিকিৎসা নিতে এসে এমন বাজে অভিজ্ঞতা থেকে রেহাই দিতে এবং উন্নত ও মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ১০ বছর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ এবং পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। চূড়ান্ত করা হয় ‘মহাপরিকল্পনা ও ডিজাইন প্রণয়ন’। কিন্তু গত বছরেও জাত
জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনার পতনের পর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে। যেখানে পাঁচ হাজার থেকে কমিয়ে সাড়ে তিন হাজার শয্যায় করার কথাও শোনা গেছে একাধিক সূত্রে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমানে ফাইলবন্দি রয়েছে এই উন্নয়ন পরিকল্পনা। অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি নিয়ে খুব একটা ভাবছে না বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।
বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য সচিব সাইদুর রহমান বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর সেই প্রকল্প থেমে গেছে। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতায় বর্তমান সরকারের পক্ষে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। প্রকল্পটি আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত পরবর্তী সরকার নেবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেলকে পাঁচ হাজার শয্যায় উন্নীতের লক্ষ্যে ২০১৫ সালে নেওয়া পদক্ষেপের ওপর পরের বছর ঢামেক হাসপাতাল সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের একটি প্রস্তাবে অনুশাসন দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাসপাতালটিতে নতুন করে সাজাতে পাঁচটি ১৮ তলা ভবন, যার প্রতিটিতে এক হাজার শয্যা করার পরিকল্পনা ছিল। দুটি আউটডোর কমপ্লেক্স, আলাদা জরুরি বিভাগ, মেডিকেল কলেজ ভবনের আধুনিকায়ন, নার্সিং কলেজকে নার্সিং ইনস্টিটিউটে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল সেই উদ্যোগে।
২৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটির কার্যক্রম পরিচালনায় কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত পুরো প্রকল্প জমা দিতে সক্ষম হন সংশ্লিষ্টরা। পরে ২০২২ সালে খসড়া ও পরের বছর চূড়ান্ত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। ওই বছর প্রকল্পটি একনেকে পাস হওয়ার কথা ছিল। আশা ছিল ২০২৪ সালেই প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হবে। শুরুতে কোটা আন্দোলন ও পরে শেখ হাসিনার পতনের এক দফা আন্দোলন তথা জুলাই বিপ্লব সামাল দিতে গিয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু করতে পারেনি তখনকার সরকার।
এই প্রকল্পের ডিজাইনের বড় অংশ হয়েছে ঢামেক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমু্ল হকের সময়ে। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করতে হয়েছে। কোন প্রক্রিয়ায় হবে, কতটা উপযোগী হবে তার সবকিছুর মহাপরিকল্পনা ও ডিজাইন করা হয়েছিল। সবকিছু চূড়ান্ত করে একনেকে পাসের পর্যায়ে গিয়েছিল। এরপরই সরকার পরিবর্তন হলো। আমার জানামতে প্রকল্পটি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারও কাজ করছে।’
বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘উদ্যোগ অনেকটা এগিয়েছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর অনেকটা থেমে যায়। তারপরও এটাকে পাঁচ হাজারের পরিবর্তে ৩ হাজার ৫০০ শয্যার হাসপাতাল করার আলোচনা হয়েছিল। তাও সেটি এখানে নয়, পূর্বাচলে করার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল, যা কোনোভাবেই ভালো সিদ্ধান্ত হতো না। আলাদা করলে ঢাকা মেডিকেলের নামে নয়, ভিন্ন নামে হওয়া উচিত। তবে যেখানেই হোক হাসপাতাল হলেই রোগীর চাপ কমবে।’
যদিও পুরো প্রকল্পটিকে অবাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. কামরুল আলম। তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলেজে কোনো নতুন ভবন কিংবা সংস্কার হয়নি। গত ১০ থেকে ১২ বছরে এই প্রকল্পের স্বপ্ন দেখানো হলেও বাস্তবে কোনো কিছুই হয়নি। হাসপাতাল ও কলেজের জন্য এখন এই ভার বহন করা কঠিন। বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থী ও ইন্টার্নি চিকিৎসকদের হল। সময়ের সঙ্গে সংস্কার হয়নি একাডেমিক ভবনেরও। শুরুর দিকে যে শিক্ষার্থী ছিল, এখন তা দ্বিগুণের কাছাকাছি। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য লেকচার গ্যালারি ও থিয়েটার নেই। সবকিছু হবে, প্রকল্পটি নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখানো হতো। কিন্তু বাস্তবতা বলছে পুরো প্রকল্পটি উচ্চাভিলাসী, অবাস্তবায়নযোগ্য।’
অধ্যক্ষ কামরুল আলম বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের একাডেমিক ভবন, ছাত্রছাত্রী এবং ইন্টার্নদের হোস্টেল সর্বোপরি হাসপাতালের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি। সেই জরুরি কাজের ২৫ থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাস হতে যখন এক যুগের বেশি সময় লাগে তখন বোঝা যায়, এই মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কারিগরি, পরিবেশগত বা আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ বা চ্যালেঞ্জ আছে। তাই সেই মেগা প্রকল্পের চিন্তা বাদ দেওয়াই সমীচীন এবং দ্রত সময়ের মধ্যে এর চেয়ে অনেক কম বাজেটে নতুনভাবে ‘মাস্টারপ্ল্যান’ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন অত্যন্ত জরুরি।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে বড় প্রকল্পগুলোর কাজ করার সুযোগ নেই। বিষয়টি যেহেতু আগের সরকারের, তাই নতুন করে দেখতে হবে। এত সময় আমাদের হাতে কোথায়? ছোট ছোট বিষয়গুলোতে আমরা নজর দিচ্ছি। আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, চাইলেই আমরা সবকিছু করতে পারব না।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: