বেপরোয়া হ্যাকার গ্রুপ, তৎপর নয় পুলিশ

‘আসসালামু আলাইকুম, ২০ হাজার টাকা লাগবে জরুরি এখন। সোমবারে দেবো, থাকলে ০১৩২৬৬৬৯৫৫০ বিকাশ পার্সোনাল এই নাম্বারে দেন। জরুরি না হলে চাইতাম না’। সাধারণত ফরম্যাট এটাই। কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও হ্যাকারদের পাঠানো মেসেজের অনেকটাই এরকমই। হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামসহ অ্যাপস হ্যাক করে এভাবে মেসেজ পাঠিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র। এদের টার্গেট পেশাজীবী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীরা। বাদ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অহরহ অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করছেন। সম্প্রতি এই হ্যাকারচক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বাড়তি ঝামেলার কারণে থানায় যোগাযোগ করতে চান না ভুক্তভোগীরা। ৫ আগস্ট-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী নানা ধরনের ষড়যন্ত্র, সড়ক অবরোধ, দাবি-দাওয়া সংবলিত সভা-সমাবেশ ঠেকানোসহ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, আওয়ামী এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নাশকতা ঠেকাতে ব্যস্ত থাকার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হ্যাকারচক্র।
গত শনিবার দুপুরে সাংবাদিক বাছির জামালের ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটি হ্যাক করে অ্যাপসটির নিয়ন্ত্রণ নেয় হ্যাকাররা। তারপর পরিচিতজনদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে এভাবেই মেসেজ দিয়ে টাকা চায়। দেওয়া হয় একটি বিকাশ নম্বর। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে জানানো হয়। হ্যাকারদের ব্যবহৃত বিকাশ নম্বরটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দেওয়া হলেও কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা অবশ্য জানা যায়নি। ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতারকচক্রের বিকাশ নম্বরগুলো ট্র্যাকিং করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজধানীর বাইরের জেলায় দেওয়া থাকে, এ কারণে তেমন কিছু করার থাকে না। এছাড়া বিষয়গুলো সময়সাপেক্ষও।
সাংবাদিক এমএ নোমানের মোবাইয়ে ০১৩২৬৬৬৯৫৫৪ নম্বর থেকে ফোন করে সাইফুল নামে পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর আইটি সেকশনের ৩০ ডিভিশন থেকে বলছি। আপনার ব্যবহৃত নম্বরটি সেনাবাহিনীর আইটি সেকশনের সঙ্গে সংযোগের কারণে আপনার নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আপনার ছোট বাচ্চা কিংবা স্ত্রী হয়তো অনলাইনে কোনো লিংকে প্রবেশ করেছেন। তাই এ সমস্যা তৈরি হয়েছে’। ওই নম্বর থেকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টার পর তিন দফায় কল দেওয়া হয়। কল দিয়ে বলা হয়, এ সমস্যা থেকে মুক্ত হতে হ্যান্ডসেটে কিছু নির্দেশনা যাবে, সে অনুযায়ী মোবাইল অপারেট করলে সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু সুবিধা করতে পারবে না মনে করে পরে আর অগ্রসর হয়নি প্রতারকচক্র।
এর আগে চলতি এপ্রিল মাসের ৯ তারিখে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক জিএম মাজহারুল ইসলামের হোয়াটসঅ্যাপ হ্যাক করে প্রতারকচক্র। একই ফরম্যাটে মেসেজ পাঠিয়ে পরিচিতজনদের কাছে টাকা চায় হ্যাকাররা। দেওয়া হয় বিকাশ নম্বর। এর মধ্যেই কয়েকজন হ্যাকারদের দেওয়া বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়েও দেন। এর আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের আরেক চাকরিজীবীর নম্বর হ্যাক করে টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকচক্রটি। তিনি এ বিষয়ে থানায় জিডি করে পুলিশ, র্যাব ও সিআইডিতে জমা দেন।
এছাড়া মাহাবুবুর রহমান ইমন নামে আরেক সাংবাদিক প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে টাকা খোয়ান। সে সময় যেসব বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠানো হয়, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে র্যাব এবং ডিবি পুলিশের কাছে দেওয়া হয়। তিন মাস পার হতে চললেও এ বিষয়ে আর কোনো আপডেট জানা যায়নি। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরীর সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, সম্প্রতি এরকম একটি প্রতারকচক্রের কাছে টাকা খুইয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হন এক ব্যক্তি। প্রতারকচক্র ব্ল্যাকমেইল করে ওই ব্যক্তির পরিবারের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রতারকচক্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একটি ব্যাংকে অনলাইনের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে ওই ব্যক্তির পরিবার। বিষয়টি খোঁজ করতে গিয়ে সিআইডি-সংশ্লিষ্টরা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য ঘেঁটে জানতে পারেন খিলগাঁওয়ের এক বাসিন্দার এনআইডি ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলে প্রতারকচক্র। কিন্তু ব্যাংকে দেওয়া ছবি এবং খিলগাঁওয়ের ওই বাসিন্দার এনআইডিতে দেওয়া ছবি এক নয়। ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা না থাকলে এভাবে অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব নয় বলে মনে করছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। এ বিষয়ে তদন্তের স্বার্থে ওই ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবে তদন্ত সংস্থা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারকচক্র অনেক ক্ষেত্রে অন্য মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে বিকাশ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে থাকে। এ কারণে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে খোঁজ নিতে গেলে আসল অপরাধীকে ধরা সম্ভব হয় না। বিষয়টি বিকাশসহ ব্যাংকগুলোকে ভেবে দেখতে হবে এবং অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে আরো বেশি যাচাই-বাছাই করতে হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: