অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে: মজিবুর রহমান মঞ্জু

শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ঘিরে পতিত আওয়ামী সরকারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী মজিবুর রহমান মঞ্জু। ওই সমাবেশে কীভাবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ, পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সম্মিলিত সশস্ত্র অ্যাকশন চালানো হয়, কীভাবে নির্দয় অত্যাচার, নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং অন্যায়ভাবে দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়- সেসব দৃশ্য স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করে রেখেছেন তিনি। শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচ
৫ মে আওয়ামী সরকারের সেই নৃশংসতা স্মরণ করে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, কিছু উগ্রপন্থি ধর্মদ্রোহী ব্লগারের বিরুদ্ধে পবিত্র ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে ও ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। এর আগে ১৩ দফা দাবির সপক্ষে মাসব্যাপী তারা বিভাগীয় শহরগুলোয় ব্যাপক গণজমায়েত করে। ৫ মে’র আগের দিন অর্থাৎ ৪ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে বিএনপির নেতৃত্বে সর্বদলীয় মহাসমাবেশ হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া সেখানে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। অনেক আশা করেছিলেন বিএনপির নেতৃত্বে ৪ মে থেকে ঢাকায় অবস্থান চালিয়ে গেলে আর পরদিন ৫ মে হেফাজতে ইসলাম চারদিক থেকে ঢাকা ঘেরাও করে রাখলে এবং একপর্যায়ে উভয় পক্ষ এক দফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলে আওয়ামী লীগের পতন অবধারিত হয়ে যেত। কিন্তু অজানা কারণে সেটা আর হয়নি।
তিনি বলেন, ৫ মে ভোর ৫টায় ফজরের নামাজের পরপরই ঢাকার প্রবেশপথগুলো অভূতপূর্ব জনসমুদ্রে পরিণত হয় হেফাজতের নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে ঢাকার উত্তরে গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গী এবং দক্ষিণে সায়েদাবাদের কাছে কাঁচপুর ব্রিজসহ রাজধানীকে ঘিরে ছয়টি প্রবেশমুখেই অবস্থান নিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে মাদরাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যোগ দেন সাধারণ মুসল্লিরাও। এরই মধ্যে চতুর্দিক থেকে মিছিল নিয়ে ঢাকার ভেতরে প্রবেশ করে মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার দাবি ওঠে বিক্ষুব্ধ আলেম-ওলামাদের পক্ষ থেকে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে পুলিশের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয় এবং একপর্যায়ে পুলিশ অনুমতি দেয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এটা ছিল মূলত সরকারের একটা ফাঁদ।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে হাজার হাজার মানুষের মিছিল নিয়ে হেঁটে মতিঝিল অভিমুখে রওনা করে। পথিমধ্যেই মিছিলগুলো কোথাও ছাত্রলীগ-যুবলীগ, কোথাও পুলিশ-বিজিবির হামলার শিকার হয়। বেপরোয়া অতর্কিত হামলায় পুরো ঢাকা শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ও আলেম-ওলামাদের রক্তে করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তারপরও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে কয়েক লাখ লোক মতিঝিল শাপলা চত্বরে এসে উপস্থিত হয়। মতিঝিলকে ঘিরে দুপুরের পর থেকেই শুরু হয় মুহুর্মুহু টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও থেমে থেমে গুলিবর্ষণ। চরম আতঙ্ক ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতেও কয়েক লাখ লোক শাপলা চত্বরে সমবেত হন এবং বিকেল নাগাদ মহাসমাবেশ শুরু হয়। যেসব মিছিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে যাচ্ছিল, তারা সবচেয়ে বেশি নির্মমতার শিকার হয়েছে।
শাপলা চত্বরে হেফাজতের ওপর চালানো আওয়ামী নৃশংসতা যাতে মিডিয়াগুলো প্রচার না হয়, সে জন্য কঠোর অবস্থানে ছিল প্রশাসন। নানা বাধা-বিঘ্ন উপেক্ষা করে সরেজমিন সংবাদ প্রচারের একপর্যায়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় জনপ্রিয় দিগন্ত টেলিভিশন এবং ইসলামিক টিভি।
সে প্রসঙ্গে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, যেহেতু ৫ মে’র ইভেন্টটি জাতীয়ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত ঘটনা ছিল এবং শুরুতেই চারদিক থেকে গন্ডগোল ও হতাহতের সংবাদ আসছিল, তাই সকাল থেকেই দিগন্ত টেলিভিশনে অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো আমরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করতে থাকি। বিকাল থেকে আমাদের রিপোর্টাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে এবং বেলা ৩টার পর মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশ শুরু হলে আমরা প্রতি ঘণ্টার নিউজে লাইভ সম্প্রচার করতে থাকি।
এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের নিহত ও আহত হওয়ার খবর আসতে থাকে। সন্ধ্যা ৬টার পর পরিস্থিতি খুবই খারাপ হতে থাকে এবং একপর্যায়ে সন্ধ্যা ৭টার পর আমাদের সরাসরি সম্প্রচারের যন্ত্রপাতি পুলিশ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। শাপলা চত্বর এলাকা থেকে আমাদের অস্থায়ী জেনারেটর, লাইভ স্ট্রিমিংয়ের বিভিন্ন সরঞ্জাম পুলিশ জোরপূর্বক অন্যায়ভাবে নিয়ে যায়। এতে আমাদের লাইভ সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের ক্যামেরাম্যান ও রিপোর্টাররা সংবাদ সংগ্রহে বাধাপ্রাপ্ত হন। সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে আমরা আর সরাসরি সম্প্রচারে থাকতে পারিনি। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে দ্রুত বেগে ছবি ও ভিডিও ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে সংগ্রহ করে আমরা সংবাদ সম্প্রচার করতে থাকি। শাপলা চত্বরের মঞ্চের পাশে এবং আশপাশের হাসপাতালগুলোয় বেশ কিছু মৃতদেহ আছে খবর পাওয়ার পর আমরা সেখানে রিপোর্টার পাঠালে প্রায় সব জায়গাতেই বাধা দেওয়া হয়। এরপর রাত যত বাড়তে থাকে, নানা দিক থেকে ভয়ংকর, হৃদয়বিদারক সব তথ্য আমরা পেতে থাকি কিন্তু পুলিশি বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে দিগন্ত টেলিভিশনের সাংবাদিক পরিচয়ে কেউ তথ্য সংগ্রহে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলেন না।
তিনি বলেন, রাত আনুমানিক ১২টার সময় নটর ডেম কলেজ প্রান্ত থেকে মুহুর্মুহু গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুলিশ ও র্যাব যৌথ অভিযান শুরু করে। আমরা সাধ্যমতো সততা ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে সংবাদ প্রচার করার চেষ্টা করি। রাত যত বাড়ছিল, ততই আমাদের কাছে নানা জায়গায় রক্তাক্ত অসহায় মানুষের হতাহতের সংবাদ আসছিল, কিন্তু কোনোভাবেই সংবাদ সংগ্রহের জন্য আমরা আর নিউজ টিম পাঠাতে পারছিলাম না।
রাত আনুমানিক ১টার দিকে আমরা খবর পাই, পুলিশ এবং র্যাবের একটি সশস্ত্র দল বাংলামোটরে ইসলামিক টেলিভিশনের অফিসে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে এবং জোরপূর্বক বেআইনিভাবে ইসলামিক টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। এই দুঃসংবাদে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি, নিউজ স্ক্রলে সংবাদটি প্রচার করা হয়।
দিগন্ত টিভি বন্ধের স্মৃতি তুলে ধরে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে সশস্ত্র শতাধিক পুলিশ ও র্যাব ফোর্স নিচের শার্টার গেট ভাঙার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে নিরাপত্তাকর্মীরা ভয়ে বাধ্য হয়ে গেট খুলে দেন। সশস্ত্র পুলিশ দল ভেতরে ঢুকেই জঙ্গি কায়দায় ভবনের সব সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে। এরপর দ্রুতগতিতে তারা দিগন্ত টেলিভিশনের সপ্তম ও অষ্টমতলা ঘেরাও করে ফেলে। নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে ৫০-৬০ জনের মতো পুলিশ ও র্যাব সদস্য নিউজ রুম, পিসিআর ও এমসিআর কক্ষে ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সিভিল ড্রেসে ছিলেন এবং তারা ছিলেন খুবই উত্তেজিত। অধিকাংশেরই মুখমণ্ডল ছিল হেলমেটে ঢাকা। সে সময় দিগন্ত টিভিতে রাত ২টার সংবাদ সম্প্রচারিত হচ্ছিল। তারা চিৎকার করে সংবাদ বন্ধের নির্দেশ দেন। তারা সরকারের অর্ডারের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। বরং পুলিশের তৎকালীন টিমপ্রধান মোল্লা নজরুল উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘অর্ডার পরে পাবেন, এখন আমাদের মাথা খুব গরম আছে, যা বলছি তা করেন’। পরে তাদের সঙ্গে আসা বিটিআরসির কয়েকজন কর্মকর্তাসহ তারা জোরপূর্বক অস্ত্রের মুখে পিসিআর, এমসিআর ও ছাদে অবস্থিত আপলিংক রুমে প্রবেশ করে সবকিছু শাটডাউন করে দেন, এনকোডার ও মডিউলেটর খুলে নেন এবং সম্প্রচার সম্পর্কিত সব গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ সিলগালা করে দেন।
পরদিন দুপুরের দিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সম্প্রচার শাখার বরাতে দিগন্ত টিভির ওপর সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মর্মে একটি অফিস আদেশ আমাদের কাছে আছে। কী কারণে দিগন্ত টেলিভিশনের ওপর সাময়িক সম্প্রচার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তা আজও আমরা জানতে পারিনি। শত শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, ফুটেজসহ সবকিছু সমূলে ধ্বংস করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী অবৈধ সরকারের একটি ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যাযজ্ঞের আলামত নষ্ট করা হয়েছে। চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কয়েক হাজার বিনিয়োগকারী ও সাংবাদিক, কলাকুশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
তিনি বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসির কর্তাব্যক্তিরা এবং পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যরা পরস্পর যোগসাজশে এই মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছেন। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিধি মোতাবেক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা ন্যায়বিচারের স্বার্থে একান্ত অপরিহার্য বলে আমি মনে করি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: