এনবিআরে প্রশাসন ক্যাডার নিয়োগের খবরে উত্তেজনা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে পৃথক দুটি বিভাগ গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের পর অধ্যাদেশটি শিগগির গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। অনুমোদিত অধ্যাদেশে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা- এই দুই বিভাগেই প্রধান হিসেবে রাজস্ব ক্যাডার বহির্ভূত প্রশাসন ক্যাডার থেকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
পাশাপাশি গঠিতব্য বিভাগ দুটির বিভিন্ন পদ পূরণেও প্রশাসন ক্যাডার থেকে জনবল নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধানে এনবিআরের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, পৃথকীকরণ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হলেও প্রশাসন ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া সঠিক হচ্ছে না। এটি হলে দেশের রাজস্ব আদায় দীর্ঘ মেয়াদে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব বিভীষণ কান্তি দাশ সত্যায়িত অধ্যাদেশের কপি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। এতে রাজস্ব নীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ দেবে।
অন্যদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের রাজস্ব আহরণ সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যোগ্য সরকারি কর্মচারীকে সচিব বা সিনিয়র সচিব পদে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এ ছাড়া উভয় বিভাগে বিভিন্ন পদেও প্রশাসন ক্যাডার থেকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
এনবিআর কর্মকর্তারা নিয়োগের এ বিধানের বিরোধিতা করে বলছেন, এখানে দুটি বিভাগেই নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের কথা বলা হলেও আইনের নানা মারপ্যাঁচে শেষ পর্যন্ত প্রশাসন ক্যাডার থেকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। এতে সমস্যা হবে। তাই সচিবসহ অন্যান্য পদে রাজস্ব ক্যাডার থেকেই নিয়োগের সুস্পষ্ট বিধান রাখতে হবে।
জানতে চাইলে বিসিএস (ট্যাকসেশন) অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, সব ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্যের একটি প্রবণতা দেখছি। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনভিজ্ঞ লোককে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে তার সুফল মিলবে না। যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে বোঝাপড়ার সমন্বয় জরুরি। জ্ঞানভিত্তিক না হলে সেক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি হবে ভিন্ন তাতে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা তৈরি হতে পারে।
এদিকে গত ১৩ এপ্রিল বিসিএস (ট্যাক্সেশন) ও বিসিএস (কাস্টমস ও ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অর্থ উপদেষ্টাকে দেওয়া স্মারকলিপিতে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সর্বোচ্চ পদসহ সব অনুবিভাগের নীতি-নির্ধারণী ও দায়িত্বশীল পদে উভয় ক্যাডার থেকে জনবল নিয়োগের দাবি জানানো হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, এনবিআরের রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব প্রশাসনকে পৃথকীকরণে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে। একই সংস্থার মাধ্যমে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কর্তৃত্ব থাকায় এটিকে স্বার্থের সংঘাত মনে করা হয়। এ ছাড়া বাড়তি চাপ কমানোর জন্যও দুটি পৃথক বিভাগ চালুর বিষয়টি গুরুত্ব পায়। আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ঋণের শর্ত হিসেবেও রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়নকে পৃথক করার বিষয়ে জোর দেয়।
অন্তর্বর্তী সরকারও এনবিআর সংস্কারে পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করে। সেই কমিটিও এনবিআর ভেঙে রাজস্ব কর নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি আলাদা বিভাগ গঠনের সুপারিশ করে। কমিটি রাজস্ব ক্যাডার থেকে সর্বোচ্চ পদে নিয়োগের সুপারিশ করলেও উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপনের আগে তা পরিবর্তন করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সংস্কার কমিটির সুপারিশে পরিবর্তন এনেছে বলে এনবিআরের কর্মকর্তারা মনে করছেন।
এ ব্যাপারে সংস্কার কমিটির সদস্য ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, ‘সুপারিশ সরকারে কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশ প্রকাশের পর ব্যক্তিগত মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
এনবিআরের সাবেক সদস্য ও সংস্কার কমিটির সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার প্রশাসন ক্যাডারের ওপর নির্ভর করে। এজন্য সব ক্ষেত্রে তাদের একটা প্রভাব থাকে। এখন এনবিআরের দুটি পৃথক বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আয়কর ও কাস্টমস, ভ্যাট ক্যাডারদের নিয়োগ দেওয়া উচিত।
কিন্তু যদি প্রশাসন থেকে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে সমস্যা তৈরি হতে পারে। আমলারা যেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্য করেন না এবং এ ব্যাপারে তাদের ধারণাও কম সেক্ষেত্রে যে কোনো নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক নাও হতে পারে। এতে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয়েও তার নীতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সংস্কার কমিটির এক সদস্য বলেন, দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের পর অনেক সংঘাত নিরসন হবে, কিন্তু তাদের কাজের সমন্বয় হবে কীভাবে? প্রশাসন ক্যাডারদের নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এটা একটা সমস্যা। পেশাদার লোকের পরিবর্তে অপেশাদার লোকদের দিয়ে নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা। এ কারণে নানা সংকটের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। বাইরের লোক নিয়োগ দেওয়া হলে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে একটা সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। জনবল নিয়োগে সংস্কার কমিটির সুপারিশের সঙ্গে অধ্যাদেশের সুপারিশে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, দেরিতে হলেও রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগকে পৃথক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে উন্নত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার একটি প্রয়াস হিসেবে আমরা দেখছি। অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে পৃথকীকরণের প্রথম ধাপ শুরু হলেও এর বাস্তবায়ন কেমন হবে তার ওপর সফলতা নির্ভর করবে।
যেহেতু এখন দুটি পৃথক বিভাগ হচ্ছে এবং এটি একটি বিশেষায়িত বিভাগ হিসেবে গড়ে তোলা হবে সেক্ষেত্রে বিশেষায়িত জ্ঞান যাদের রয়েছে তাদেরই যত বেশি সম্ভব সম্পৃক্ত রাখা উচিত হবে। রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যারা অভিজ্ঞ তাদের নেতৃত্বেই বিভাগ দুটি পরিচালিত হলে তুলনামূলকভাবে প্রশাসনিক লোকদের তুলনায় ভালো করবেন। সুতরাং এক্ষেত্রে রাজস্ব ক্যাডারদের অগ্রাধিকার থাকাই বাঞ্ছনীয়। তবে যারা এক্ষেত্রে নিয়োগ পাবেন তাদের সরকার পরিচালনা ও নীতি নির্ধারণ বিষয়েও সম্যক ধারণা থাকতে হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: