সড়ক ও সেতু বিভাগ ছিল হাসিনার কমিশন বাণিজ্যের হাট

প্রকাশিত: ২০ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:০৪ এএম
আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫ ৯:০৮ এএম

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে সড়ক ও সেতু বিভাগ ছিল কমিশন বাণিজ্যের হাট। এ খাত থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়েছেন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাসহ প্রভাবশালী চক্র।

বড় বড় প্রকল্প থেকে একাধিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি অর্থ লোপাট করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রভাবশালী কিছু কর্মকর্তাও অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন, যার ভাগ নিয়েছেন শেখ পরিবারের অনেক সদস্য।

জানা গেছে, চক্রটি কমিশন বাণিজ্যের অর্থের অধিকাংশই হুন্ডিসহ অবৈধ বিভিন্ন উপায়ে পাচার করত যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে। তবে বড় লেনদেনগুলো সরাসরি লন্ডনে হয়েছে। ওই সিন্ডিকেটের পালের গোদা ছিলেন শেখ রেহানার ‘খাস লোক’হিসেবে পরিচিত তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। হাসিনা-রেহানার ফুপাতো ভাই ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিন, হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ও শেখ রেহানার দেবর মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকও ছিলেন অন্যতম হোতা।

তাদের সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী ও এমপি। তারা এবং তাদের ঘনিষ্ঠ বা স্বজনরা মিলে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এক যুগের ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেছেন, নিয়েছেন ইচ্ছামতো কমিশন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন অধিদপ্তরগুলোর বেশ কয়েকটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) তথ্যে দেখা যায়, গত ১৩ বছরে (২০১১ থেকে ২০২৪) সড়ক-সেতু নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার কাজ অর্থাৎ ৯০ শতাংশ প্রকল্প একক ও যৌথভাবে পেয়েছে ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত সহস্রাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্ট এই ১৫ প্রতিষ্ঠান শেখ পরিবারকে ‘খুশি করে’সিংহভাগ কাজ বাগিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী তাদের সহায়তা করেন। এতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরের কিছু কর্মকর্তা ও শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সম্পৃক্ততাও রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা তিন মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারে ২০১১ সালের ডিসেম্বর থেকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ওবায়দুল কাদের। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখলের পর ওয়ান-ইলেভেনে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে দল ও সরকারে উপেক্ষিত ছিলেন ওবায়দুল কাদের। পরে তিনি একাধিক মাধ্যম ব্যবহার করে শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হন।

এতে সুফলও মেলে। প্রথমে তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য হন। পরে শেখ রেহানাকে হাত করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে বাদ দিয়ে ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক করতে শেখ হাসিনা অনিচ্ছুক হলেও রেহানার চাপাচাপিতে তাকে পদটি দেওয়া হয়। ক্লিন ইমেজের আশরাফকে বাদ দিয়ে কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক করায় দলের অনেক নেতাও ওই সময় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। টানা তিন মেয়াদেই তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিবার সম্মেলনের আগে তার নাম বাদ পড়ার খবর চাউর হলেও ‘অদৃশ্যে’ কারণে বাস্তবে তা ঘটেনি।

শেখ রেহানার ‘ডানহাত’ হিসেবে পরিচিত ওবায়দুল কাদের দীর্ঘদিন মন্ত্রী থাকায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে কেন্দ্র করে অন্তত তিনটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। ওই চক্রের মাথা ছিলেন শেখ পরিবারের সদস্যরা। নিচের দিকে ছিলেন ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদের, তার কয়েকজন স্বজন ও ঘনিষ্ঠজন, আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী-এমপি এবং সওজের কয়েকজন সুবিধাভোগী আর দলবাজ প্রকৌশলী।

তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল সওজের ঠিকাদারি কাজ, চলে রমরমা কমিশন বাণিজ্য। কমিশনের একটি অংশ সরাসরি যেত শেখ রেহানার কাছে। তাতে সব প্রকল্প থেকে কত অংশ দেওয়া হবে, তা একপ্রকার নির্ধারিতই ছিল। এ ছাড়া আরেক অংশ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা থেকে শুরু করে শেখ হাসিনা পর্যন্ত যেত। ওই‌ সিন্ডিকেটের কাছে সওজ কর্মকর্তাদের অনেকেই ছিলেন অসহায় আর কিছু কর্মকর্তা নিয়েছেন ফায়দা।

এদিকে ২০১১ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও দুর্নীতিচেষ্টার অভিযোগ ওঠায় পরের বছর প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে যায় সংস্থাটি। তখন টানাপড়েনের মধ্যেই শেখ হাসিনা ও রেহানার কাছের লোক হিসেবে পরিচিত যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ছুটিতে পাঠানো হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান ও সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে। সাতজনকে আসামি করে দায়ের করা হয় মামলা। ওই সময় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে তদন্ত করা হলেও অদৃশ্য কারণে উল্টো ক্লিন সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। অবশ্য শেখ হাসিনার পতনের পর দুদক পদ্মা সেতুর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পুনরায় তদন্ত করছে।

সংস্থাটির মহাপরিচালক আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, কিছু তথ্যপ্রমাণ পাওয়ায় মামলাটির বিষয়ে অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ তাদের পরিবারের দেশ-বিদেশে লেনদেনের যাবতীয় নথি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক ঠিকাদার জানান, শেখ পরিবারের সদস্যদের খুশি করার পাশাপাশি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং সওজের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট হারে ‘কমিশন’ দিতে হতো। এসব প্রভাবশালীকে কমিশন না দিলে বড় প্রকল্প মিলত না। কমিশন বাণিজ্য করে তারা বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়েছেন, দেশ-বিদেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাদের সম্পদ অনুসন্ধান করলেই বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।

২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সওজের সিংহভাগ কাজ বাগিয়ে নেওয়া ১৫ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো— হাসান টেকনো বিল্ডার্স ১১ হাজার ১১৮ কোটি টাকার ৫৬৩টি কাজ, রানা বিল্ডার্স ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকার ৫২৬টি কাজ, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই) আট হাজার ৬৫০ কোটি টাকার ১৫৫টি কাজ, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ ছয় হাজার ৫৩১ কোটি টাকার এক হাজার ৩০৯টি কাজ, মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড ছয় হাজার ৪৬৫ কোটি টাকার ৭০২টি কাজ, তাহের ব্রাদার্স চার হাজার ৯৮০ কোটি টাকার ১৫৭টি কাজ, মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড চার হাজার ৫৬৯ কোটি টাকার তিন হাজার ৮৯৪টি কাজ, মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ার্স চার হাজার ৩৮১ কোটি টাকার ১৬০টি কাজ, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স তিন হাজার ৯৩৩ কোটি টাকার ৫১টি কাজ, এমএস সালেহ আহমেদ দুই হাজার ৯৬০ কোটি টাকার ১৭১টি কাজ, এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স দুই হাজার ৮২৩ কোটি টাকার ৬৫টি কাজ, রিলায়েবল বিল্ডার্স দুই হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার ৬৫টি কাজ, তমা কনস্ট্রাকশন দুই হাজার ৩০৯ কোটি টাকার ৫৯টি কাজ, মাহফুজ খান লিমিটেড দুই হাজার ২৮২ কোটি টাকার ১৭৬টি কাজ এবং আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন এক হাজার ৯৩১ কোটি টাকার এক হাজার ৭০০ কাজ পায়।

এরমধ্যে জালিয়াতি ও ভুয়া নথি দেখিয়ে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ পাওয়ায় গত বছর কমপক্ষে ৪৫ প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এরমধ্যে স্পেক্ট্রা ও এমএম বিল্ডার্স ছাড়া শীর্ষ ১৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানকে ব্ল্যাকলিস্টেড করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সবচেয়ে বেশি টাকার কাজ বাগিয়ে নেওয়া হাসান টেকনো বিল্ডার্সের মালিক নাজমুল হাসান। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রানা বিল্ডার্সের মালিক মো. আলম। তারা সম্পর্কে মামা-ভাগনে। দুজনেরই বাড়ি কুমিল্লায়। এরমধ্যে নাজমুল হাসান কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ঘনিষ্ঠ। আবার মাসুদ হাইটেকের মালিক জুলফিকার হোসেন (মাসুদ রানা) মো. আলমের ভাতিজা। জুলফিকার শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সালাহউদ্দিন (শেখ জুয়েল) ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ।

এনডিই ২০১৭ সালের শেষদিকে সড়কের ঠিকাদারি কাজ শুরু করে মাত্র ছয় বছরে একক ও যৌথভাবে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার কাজ পায়, যা মোট কাজের ১০ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির পেছনে তারিক আহমেদ সিদ্দিক থাকায় কাজ দিতে কর্মকর্তাদের বলে দিয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের। এনডিইর সঙ্গে যৌথভাবে ৩৯টি কাজ করে সাগর ইনফো বিল্ডার্স। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও তারিক আহমেদ সিদ্দিক-ঘনিষ্ঠ।

মোজাহার এন্টারপ্রাইজের মালিক কাজী মোজাহারুল ইসলাম শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড ও মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড সওজ কর্মকর্তাদের নির্ধারিত হারে ‘কমিশন’ দিয়ে কাজ পেত। তারা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যখন যাকে দরকার ব্যবহার করত।

এমএস সালেহ আহমেদের মালিক সালেহ আহমেদ (বাবুল)। তিনি ফেনী-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী (নিজাম হাজারী) ও ওবায়দুল কাদেরের খুবই ঘনিষ্ঠ। রিলায়েবল বিল্ডার্সের মালিক শফিকুল আলম (মিথুন) শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ঘনিষ্ঠ। রিলায়েবলকে কালো তালিকা থেকে বাদ দিতে দফায় দফায় ফোন করেন শেখ সেলিম।

তমা কনস্ট্রাকশনের মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীও হয়েছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, ওবায়দুল কাদের ও নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ মনোনীত সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ। মাহফুজ খান লিমিটেডের মালিক মাহফুজ খানের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সঙ্গে।

২০১৮ সালে সড়কের ঠিকাদারি শুরু করা আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের মালিক আবেদ মনসুর আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায়বিষয়ক উপকমিটির সদস্য। ঢাকা-১৭ আসনে দলটির প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম নিয়েছিলেন। তার বাড়িও নোয়াখালী। তিনি ওবায়দুল কাদের ও তার ভাই আবদুল কাদের মির্জার ঘনিষ্ঠ।

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র কাদের মির্জা, ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদের ও একরামুল করিম চৌধুরীর সড়কে একটি প্রভাবশালী চক্র ছিল। তারা বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কমিশন নিয়ে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। কমিশনের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে ২০২০ সালে কাদের মির্জার ‘সত্যবচনের’ মধ্য দিয়ে। সে সময় তাকে ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলতে দেখা যায়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ওবায়দুল কাদের, কাদের মির্জা, নিজাম হাজারী, একরাম চৌধুরী, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, বাহাউদ্দিন বাহারসহ প্রভাবশালী নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদেরের বক্তব্য নেওয়ার জন্য চেষ্টা করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি।

এদিকে সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেকগুলো আবার বঞ্চিত সেজে সওজের কাজ পেতে তৎপরতা চালাচ্ছে। সম্প্রতি সওজের প্রধান প্রকৌশলীকে ১০ দফা দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া ৯ প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও সুবিধাভোগী পাঁচটি রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো হাসান টেকনো বিল্ডার্স, এনডিই, রিলায়েবল বিল্ডার্স, মাসুদ হাইটেক ও এমএস সালেহ আহমেদ।

এ ছাড়া ছোট ও মাঝারি কিছু প্রতিষ্ঠানও অনেক বড় অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। এর মধ্যে অন্যতম জে এন্টারপ্রাইজ। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ১৯৭ কোটি টাকার ১০টি কাজ পায় প্রতিষ্ঠানটি। সূত্রমতে, প্রতিষ্ঠানটির পেছনে ছিলেন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচিত ‘পিয়ন’ জাহাঙ্গীর আলম। এই জাহাঙ্গীর প্রতারণার মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়াসহ গাড়ি-বাড়ি করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে অনুসন্ধান করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

একাধিক সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনের পিয়ন ছিলেন জাহাঙ্গীর। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তার ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ পরিচয় দিতেন জাহাঙ্গীর। এ পরিচয় ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের পদ, চাকরি, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করেন তিনি। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদও বাগিয়ে নেন। সেই সঙ্গে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়েন গত ১৫ বছরে।

জানা যায়, গত দেড় যুগে সওজে ৪০ হাজারের বেশি দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরমধ্যে এক লাখ থেকে এক কোটি টাকার মধ্যে দরপত্রের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩৬ হাজার। এর মোট ব্যয় প্রায় ছয় হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বাকি চার হাজারের মতো দরপত্রের মূল্য ছিল এক কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকা বা তারও বেশি মূল্যের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কজন ঠিকাদার বলেন, ছোট ছোট কাজেও ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। এ ছাড়া সব প্রকল্পে আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রকৌশলীদের ১০-১৫ শতাংশ কমিশন দিয়ে কাজ করতে হতো। মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ঘুস ও চাঁদার জন্যও অর্থ গুনতে হতো।

এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর, মন্ত্রণালয় বা সরকারকে স্বাধীন তদন্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বর্তমান সরকারকে উন্নয়নের নামে লুটপাট হওয়া বিষয়ে রেগুলেটরি কমিশন করে সংস্কার আনতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, দপ্তরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রণালয়। গত ১৫ বছরে কী মন্ত্রণালয়, কী ডিপার্টমেন্টÑ পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এটা পুরো ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অনিয়ম হলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রধান প্রকৌশলীর ধরার কথা, তিনি অনিয়ম করলে মন্ত্রণালয়ের ধরার কথা, মন্ত্রণালয় যোগসাজশ করলে সংসদীয় কমিটির ধরার কথা।

কিন্তু তারা সবাই সিন্ডিকেট হয়ে গেছে, তারা সবাই সুবিধা নিয়েছে। এ প্রক্রিয়া গত সরকারের সময় হালুয়া-রুটি হয়ে যায়। এ কারণে দেড় দশক শুধু রমরমা দুর্নীতিই হয়েছে। যাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা, তাদের অনেক অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এমনকি দেড়-দুই কোটি টাকা মূল্যের দু-তিনটি করে গাড়ি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। এখানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের লোকজন পর্যন্ত সুবিধা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়েছিল।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, আইনের অপব্যবহার করে এসব লুটপাট করা হয়েছে। তদন্ত করে লাভ হয় না। কিছু প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হলেও আদালতের মাধ্যমে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে বর্তমান সরকার সংশ্লিষ্ট আইন পরিবর্তন করেছে।

উপদেষ্টা আরো বলেন, তদন্তের কাজগুলো সড়কের লোক দিয়েই করাতে হয়। তারা তো তাদের সহকর্মীর অনিয়ম ঢাকার চেষ্টা করবে। তদন্ত করে হয়তো বলবেÑ ঠিকই আছে, আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রকল্পগুলো দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতে তো কোনো লাভ হবে না। এজন্য দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আমাদের পক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে। এরকম অনেক কিছুই তদন্তের জন্য দিয়ে কিছু পাওয়া যায়নি।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর